জয়নুল আবেদিন: বাংলার মানসে গড়া শিল্পী

Md. Emran Hossen
0

 শিল্পী জয়নুল আবেদিন ছিলেন খুব ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকতেন। প্রকৃতির প্রতি ছিল তার অসীম টান। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, ফুল, গৃহপালিত প্রাণী, গাছ এসব এঁকে এঁকে মা- বাবাকে দেখাতেন। ছেলেবেলার জয়নুল ছিলেন ঠিক এমন যেন চিত্রকলার জন্যই তার জন্ম হয়েছে। বাস্তবে ঘটলোও তাই যেন, সকলের প্রিয় আজকের শিল্পাচার্য তো আর তিনি একদিনে হননি, ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছেন এক কিংবদন্তির শিল্পী।

৪০-এর দশকে কলকাতা আর্ট কলেজে পড়তেন। তারপর সেখানে শুরু থেকেই তিনি তার আঁকার প্রতিভাবলেই যেন মন জয় করে নেন সকলের। তখনকার সে সময়ে আর্ট একটা আশ্চর্যের বিষয়, তার ওপরে বাঙালি মুসলমান সমাজে তো আরও গোঁড়া ব্যাপার। ময়মনসিংহে ডিসেম্বর মাসের ২৯ তারিখ ১৯১৪ সাল, জয়নুল জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থানটি আজকের কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়া উপজেলা। তার বাবা তমিজউদ্দিন সাহেব ছিলেন পুলিশের দারোগা আর মা জয়নাবুন্নেছা ছিলেন গৃহিনী। বাবা-মায়ের নয় সন্তানের মধ্যে জয়নুল ছিলেন জ্যেষ্ঠ। পারিবারিক আবহেই শুরু হয়েছিল তার পড়াশোনার প্রথম দিকটা।


জয়নুলের বয়স যখন ষোল বছর তখন তিনি ঘটালেন এক মজার ঘটনা। কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে পালালেন, বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় গেলেন কেবলমাত্র গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার আশায়। তারপর ফিরলেন তিনি বাড়িতে কিন্তু পড়ালেখায় তার আর মন বসতে চাইলো না। অবশেষে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে মায়ের ক্ষীণ সমর্থন পেয়ে ওই স্বপ্নের কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। জয়নুল সেখানে ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৩৮ সালঅব্দি পড়ালেখা করেন। তারপর সেখান থেকে তিনি প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে। 

জয়নুল যুক্ত হন কলকাতা আর্ট কলেজের শিক্ষকতায়। কিন্তু তিনি ছিলেন মনে প্রাণে একজন বাঙালি। বাংলার নদী, বাংলার জল, মাঠ, ঘাট, বৃক্ষ, পাখি, লতা, পাতা, প্রাণি- এ সবুজ প্রান্তর ছিল তার চির আরাধ্য। তিনি আঁকতে থাকেন নিজের মতোই- যেখানে উঠে আসে নানা সময়ে নানান রূপ। নিসর্গ প্রিয় জয়নুল যেন নিসর্গকেই বেছে নিলেন- টানলেন তার তুলিতে জীবন্ত সব প্রাণ প্রকৃতি। তার ভেতর কখনো ছিল না শিল্পী হিসেবে অহংবোধ, তবে বাঙালি হিসেবে বরাবরই তিনি দায়বোধ মনে করতেন নিজের দেশের জন্য। 


১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর নবগঠিত পাকিস্তানের একটি অংশ ছিল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ, তখনকার দিনে পূর্বপাকিস্তান। এরপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন হয়, এদেশে তরুণেরা ভাষার জন্য লড়াই করে। সবশেষে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয় বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতা। পৃথিবীর বুকে সবুজের বুকে লাল সূর্যের জানান দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে ওঠে পূর্ণাঙ্গ এক রাষ্ট্র। এই স্বাধীন দেশের প্রধান শিল্পী যারা ছিলেন সেই সময়ে তাদের পুরোধা ছিলেন জয়নুল আবেদিন। তিনি তখন স্বাধীন দেশে শুরু করেন আর্ট ইন্সটিটিউট। মাত্র ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল।

তিনি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক। প্রাণ মন দিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গড়ে তোলেন তিনি আজকের আর্ট ইন্সটিটিউট। এরপর তিনি স্বপ্নের লোকশিল্প সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন সোনারগাঁয়ে। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, গ্রাম থেকে গ্রামে গিয়ে বাংলার সব হারিয়ে যাওয়া শিল্পকর্মের সংগ্রহ করতে থাকেন। ফলে শিক্ষক জয়নুল আবেদিন, সংগঠক জয়নুল আবেদিন আর শিল্পী জয়নুল আবেদিন ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা মানস। একদিকে তিনি চেয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের সমস্ত দৃশ্যকে বিশেষত নিসর্গকে নিজের ভেতর ধারন করে লাইন ড্রইংয়ে আঁকতে, অন্যদিকে চেয়েছেন বাঙালির নিজস্ব পরিচয় হোক নিজস্ব আর্ট, আবার চেয়েছেন হারিয়ে যাওয়া সব শিল্পকর্মের সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে। একজন প্রবাদপ্রতীম শিল্পী ছিলেন তিনি। মননে বাঙালি শিল্পী। শিল্পের দর্শনে তিনি এদেশের নিসর্গপ্রেমী একজন স্রষ্টা। 


জয়নুল আবেদিন ছাত্র বয়সেই শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার আঁকা চিত্রে উঠে আসে মানুষের দুঃখগাথা, ব্যথা, বেদনা এবং বাংলার চিরায়ত দৃশ্য। তিনি যেমন এঁকেছিলেন দুর্ভিক্ষর ছবি। যখন ৪৩ সালে মানুষ না খেয়ে- অন্নের অভাবে মারা যাচ্ছে তখন তিনি আঁকেন সেই দুর্ভিক্ষের করুণ দৃশ্য। আবার বিদ্রোহী নামে ১৯৫১ সালে জলরঙে আঁকেন আরও একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম। তিনি সেই ছবিতেও দেখিয়েছিলেন নিজস্বতা। তুলির মোটা ও সাবলীল দাগের মাধ্যমে একটি গাভীর দড়ি ছেঁড়ার প্রচণ্ড এক উন্মত্ততা প্রকাশ পেয়েছিল সে ছবিতে। বিদ্রোহী নামের এ চিত্রকর্মটি ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে গেলে দেখতে পাওয়া যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচারের জবাব হয়ে এখনও জ্বলজ্বল করে সেই বিদ্রোহী ষাঁড়। এ ছিল অর্থনৈতিক ভাবে আমাদের এদেশের মানুষকে ভেঙে ফেলার জন্য তীব্র এক প্রতিবাদ।

জয়নুল সহাস্য সাবলীল সদালাপী শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু মনে ছিল সেই কিশোরের জিদ। জয় করতেই তিনি যেন জন্মেছিলেন সেই অবিভক্ত বাংলার সেদিনের কেন্দুয়ায়। জয়নুলের শিল্পের এই নিজস্বতাকে স্বদেশের প্রতি, নিজের মায়ের প্রতি এক অসীম দায়িত্বশীল এক মানুষ রূপে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার কাজের জন্য তিনি এ কারনে সকলের কাছে প্রিয় হয়ে আছেন। শিল্পের গুরু এই শিল্পী আজীবন শিল্পাচার্য হয়ে আছেন আমাদের মনে।


তার সেই রেখে যাওয়া দেশাত্মবোধের চেতনাকে তাই মনে হয় আমাদের আরও শাণিত করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। না হলে এদেশে শিল্পের চর্চায় সমকালে নেই কেন নতুনত্ব, তবে কী হারিয়েছি আমরা সব-ই? নাকি জয়নুল আবেদিনের স্বপ্নকে আমরা বুঝতে পারিনি, চিনতে পারিনি শেকড়কে? জয়নুল তো বরাবরই শেকড়ের সন্ধানে ফিরেছেন। তিনি তাই স্বপ্ন দেখতেন এদেশ থেকে বিশ্বের বুকে আসবে আবার নতুন কোন শিল্পী যে বিশাল বাংলাকে নবতর রূপে পরিচয় করাবে বিশ্বের বুকে। তেমন শিল্পীরই আজ দরকার। যারা হবেন শিল্পী জয়নুল আবেদিনের মতো- শিক্ষক, সংগঠক এবং এদেশের শিল্পী। যারা ছড়িয়ে দেবেন শিল্পী জয়নুলের চিন্তা ও মতকে দিকে দিকে। 

জয়নুল আবেদিন বাংলার চিত্রকলার রূপকার, তিনি আমাদের অহঙ্কার। বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির অহঙ্কার। দেশ, মাটি ও মানুষের কল্যানে আজীবন নিবেদিত ছিলেন। সত্যিকার দেশপ্রেমিকরা কখনো ভোলেন না এই মহৎপ্রাণ মানুষদের। দেশপ্রেমিক চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের কথাও এ দেশবাসী কখনো ভুলবে না। কারণ, তিনি আজীবন লড়াই করেছেন এ দেশের শিল্পচর্চার প্রতিকূল পরিবেশ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনসহ সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে।


তিনি একদা যেমন দুর্ভিক্ষের চিত্র এঁকে বিশ্ববিবেকের সম্মুখে মাতৃভূমির করুণ দৃশ্যাবলি ফুটিয়ে তুলে আন্তর্জাতিক বলয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন; ঠিক তেমনি তিনি মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য সফর করে ফিলিস্তিনিদের শক্তি-সাহসও দিয়েছিলেন তার রঙতুলির আঁচড়ে। আজকের দিনের তারুণ্যদীপ্ত শিল্পীদের জন্য এক আদর্শ উদাহরণ তারই বলিষ্ঠ রঙতুলির আঁচড়ে আঁকা চিত্রকর্মগুলো। যারা আজ সারাবিশ্ব থেকে সুনাম কুড়িয়ে দেশের চিত্রশিল্পকে আলোড়িত করছেন, সেইসকল শিল্পীদের প্রাণের মানুষ- জয়নুল আবেদিন।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
Post a Comment (0)
">
Thanks for visiting our website! Learn More
Not Now!